সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, সামনে বিশাল সেই সমুদ্র। কক্সবাজার গেলে সকালে-বিকেলে সমুদ্রতীরে বেড়াতে মন চাইবে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। নীল জলরাশি আর শোঁ শোঁ গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকতের নামই হল কক্সবাজার। অপরূপ সুন্দর বিশ্বের বৃহত্তম এই সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। যারা সপরিবারে এখানে বেড়াতে চান তাদের জন্যই এই লেখা।
মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, মাতার বাড়ি, শাহপরী, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজারকে করেছে আরো আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। এ জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক নদী এগুলো হল মাতা মুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কুহেলিয়অ ও নাফ। পর্যটন, বনজসম্পদ, মৎস্য, শুটকিমাছ, শামুক, ঝিনুক ও সিলিকাসমৃদ্ধ বালুর জন্য কক্সবাজার অনেক বিখ্যাত তাই ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের কাছে এর স্থান সবার উপরে রয়েছে।
সমুদ্রে নামার সতর্কতা ও অন্যান্য তথ্যাবলী: সমুদ্রে নামার আগে অবশ্যই জোয়ার-ভাটার সময় জেনে নিতে হবে। এ সম্পর্কিত ইয়াছির লাইফ গার্ডের বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড ও পতাকা রয়েছে সেখানেবিচের বিভিন্ন স্থানে তা লাগানো আছে। মূলত জোয়ারের সময় সমুদ্রে গোসলে নামা নিরাপদ হয়ে থাকে। এ সময় জোয়ারের সময় নির্দেশিত থাকে, পাশাপাশি সবুজ পতাকা ওড়ানো হয়ে থাকে। ভাটার সময়ে সমুদ্রে স্নান খুবই বিপজ্জনক ভাটার টানে মুহূর্তেই হারিয়ে যেতে পারে যে কেউ। তাই এ সময় বিচ এলাকায় ভাটার সময় লেখাসহ লাল পতাকা ওড়ানো থাকলে সমুদ্রে নামবেন না। কোনোভাবেই দূরে যাবেন না। প্রয়োজেন পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ইয়াছির লাইফ গার্ডের সহায়তা নিতে পারেন। ওদের জানিয়ে বিচে নামা উচিত।
বিচ ফটোগ্রাফি: কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে বিচ ফটোগ্রাফার পর্যটকদের বিভিন্ন রকমের ছবি তুলে থাকে। মুহুর্তের মধ্যেই এসব ছবি প্রিন্ট করে নেগেটিভসহ পর্যটকদের হাতে দিয়ে দিয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। লাল পোশাক পরা বিচ ফটোগ্রাফারদের প্রত্যেকের একটি করে আইডি কার্ড রয়েছে। কয়েকটি স্টুডিও এ কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। সরকারি রেট অনুযায়ী ফোরআর সাইজের ছবির দাম ৩০ টাকা হয়ে থাকে। এ সম্পর্কিত সাইনবোর্ড মেইন বিচে দেখতে পাওয়া যায়। এসব বিচ ফটোগ্রাফারদের কাছ থেকে ছবি তোলার আগে আইডি কার্ড দেখে নিবেন।
স্পিডবোট: বিচে কয়েকটি স্পিডবোট আছে। মেইন বিচ থেকে এই বোট গুলো চলাচল করে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত। এর ভাড়া নির্ধারণ করা হইছে এক রাউন্ড ১০০টাকা। এছাড়া খোলা স্পিডবোটের সাহায্যে চলে লাইফ বোট জনপ্রতি ভাড়া ২৫০ টাকা।
বিচ বাইক: তিন চাকার বেশ কয়েকটি বিচে চলার উপযোগী বাইক কক্সবাজার সাগর সৈকতে বেশ জনপ্রিয়। প্রায় ১ কিলোমিটার দূরত্বে এসব বাইক রাউন্ড প্রতি ৫০ টাকা করে পর্যটকদের প্রদান করতে হয়।
হিমছড়ি ও ইনানী বিচ ভ্রমনঃ কক্সবাজার থেকে ১২-২২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দুটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। একটি হলো হিমছড়ি এবং আর একটি হলো ইনানী বিচ। কক্সবাজার সমুদ্র থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে অন্যতম সমুদ্র সৈকত ইনানী সমুদ্র সৈকত। আর এই সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার মাত্র ১২ কিলোমিটার গেলেই দেখা যায় আরেক দর্শনীয় পর্যটন স্থান হিমছড়ি। খুব সকালে গেলে জায়গা দুটি জায়গা ঘুড়ে আবার দুপুরের মধ্যেই ফিরতে পারবেন কক্সবাজার শহরে।
যাতায়াত ও ভাড়া : ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যেতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার অথবা সরাসির বাসে কক্সবাজারে যেতে হয়। ঢাকার ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিলসহ কয়েকটি স্থানে সরাসরি কক্সবাজারের বাস পাওয়া যায়। এসি ও নন এসি, ডিলাক্স ও সাধারণ এসব সরাসরি সব বাস পরিবহনের ভাড়া ৪০০-১২০০ টাকা । সোহাগ, গ্রীন লাইন ছাড়াও ঈগল ও অন্যান্য পরিবহনের বাস চলাচল করে। ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে প্রথমে চট্টগ্রাম এবং পরে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি কক্সবাজারে যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে ট্রেন বা বাস যায়। তবে টিকেট বুকিং আগে করে রাখতে হয়।
কক্সবাজারের আবাসিক ব্যবস্থা: বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে কক্সবাজার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও দর্শনীয় বিচ কক্সবাজারে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের কয়েকটি হোটেল ও রিসোর্ট। এছাড়া সরকারি ও ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ছোট বড় বিভিন্ন রকমের অনেক রিসোর্ট, হোটেল ও বোর্ডিং হাউস। সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকায় কক্সবাজারে থাকা যায়। হোটেল সিগালের ভাড়া ২,২০০-৭,০০০ টাকা। হোটেল শৈবালের ভাড়া ১,০০০-৩,০০০ টাকা। হোটেল লাবণীর ভাড়া ৬০০-৩,০০০ টাকা। উপলের ভাড়া ১০০০-১৫০০ টাকা। সি ক্রাউনের ভাড়া ২০০-৩,০০০ টাকা। জিয়া গেস্ট হল ৩০০-২,০০০ টাকা। ভাড়া অন্যান্য হোটেল রেস্টহাউসের ভাড়া প্রায়ই নির্ধারিত। কক্সবাজার ভ্রমণের পূর্বে ফোনে যোগাযোগ করে বুকিংমানিং পাঠিয়ে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ভালো। সরাসরি গিয়েও কথা বলে রুম ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
খাওয়াদাওয়া ও রেস্টুরেন্ট: প্রতিটি আবাসিক হোটেলের পাশে রেস্টুরেন্ট বা খাবার হোটেল রয়েছে। কক্সবাজারে গিয়ে পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ থাকে সাগরের বিভিন্ন মাছের প্রতি। বিশেষ করে চিংড়ি, রূপচাঁদা, লাইট্যা, ছুরি মাছ মজাদার হয়ে থাকে শুটকি মাছের ভর্তার প্রতিটি পর্যটকদের আকর্ষণ বেশি থাকে। খাবারের মেন্যু অনুযায়ী এক একটি রেস্টুরেন্টে এক এক ধরনের মূল্য তালিকা রয়েছে। তবে বর্তমানে সরকার নির্ধারিত কিছু কিছু তালিকা ভোজন রসিকদের নির্ধারণ করেছে। ১০-৫০০ টাকার মধ্যে সাধ্য অনুযায়ী মজাদার খাবার গ্রহণ করতে পারবেন পর্যটকরা। তবে খাবার গ্রহণের পূর্বে খাবারের নাম, মূল্য এবং তৈরির সময় সম্পর্কে জেনে নেয়া অবস্যক। প্রয়োজনে খাদ্যের তালিকা ও মূল্য লিখে রাখুন। তালিকা সঙ্গে মিলিয়ে বিল করুন।
সেন্টমার্টিন ভ্রমনের প্রয়োজনীয় তথ্য: আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল সেখানে মিশে একাকার, তীরে বাঁধা নৌকা, নান্দনিক নারিকেল বৃক্ষের সারি আর ঢেউয়ের ছন্দে মৃদু পবনের কোমল স্পর্শ এটি বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপের সৌন্দর্য বর্ণনার ক্ষুদ্র প্রয়াস। বালি, পাথর, প্রবাল বা জীব বৈচিত্র্যের সমন্বয়ে জ্ঞান আর ভ্রমণ পিপাসু মানুষের জন্য অনুপম অবকাশ কেন্দ্র হচ্ছে সেন্টমার্টিন। জেলি ফিশ, হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ, প্রবাল বিশ্ব রহস্যের জীবন্ত পাঠশালায় পরিণত হয়েছে সেন্টমার্টিন ও তৎসংলগ্ন এলাকাকে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। কক্সবাজার জেলা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগর বক্ষের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ হল সেন্টমার্টিন। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আয়তন হল ১৭ বর্গ কিলোমিটার। টেকনাফ থেকে ট্রলারে কিংবা জাহাজে যেতে লাগে দুই থেকে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা। এর জনসংখ্যা অনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার। নারিকেল, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো ধান এই দ্বীপের প্রধান কৃষিজাত পণ্য। আর অধিবাসীদের সবারই পেশা হচ্ছে মৎস্য শিকার। তবে পর্যটন শিল্পের বিকাশের কারণে অনেকেই রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল বা গ্রোসারি শপের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে বর্তমানে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষ সহজ-সরল, তাদের উষ্ণ আতিথেয়তা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। স্বল্প খরচে পর্যটকদের জন্য রয়েছে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
সেন্টমার্টিন যেভাবে যাবেন : বাংলাদেশের যে কোনও স্থান থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য প্রথমে কক্সবাজার যেতে হবে। কক্সবাজার থেকে জিপে চড়ে টেকনাফ, টেকনাফ থেকে সি-ট্রাক, জাহাজ বা ট্রলারে চড়ে সেন্টমার্টিনে যেতে পারবেন। প্রতিদিন ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যায় বহু দূরপাল্লার গাড়ি। বাসের ভাড়া লাগবে এসি ৮০০ – ১২০০ এবং নন-এসি ৪০০-৭০০ টাকা।তারপর বাসে ৩০-৫০ টাকা, ট্যাক্সিতে ৪০-৬০ টাকা বা রিজার্ভ মাইক্রোবাসে টেকনাফ যেতে ভাড়া লাগে ৫০০-১০০০ টাকা (৮-১০ সিট)। প্রতিদিন সকাল থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ রুটে চলাচল করে এই সমস্ত গাড়ি। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন সকাল থেকে আসা-যাওয়া করে সি-ট্রাক, কেয়ারি সিন্দাবাদ এবং নাফসি হাজাজ। এসব জাহাজের পাশাপাশি ট্রলারও চলাচল করে এই রুটে। তবে নিরাপদ জলযান হিসেবে কেয়ারি সিন্দাবাদ ও নাফসি জাহাজই নির্ভরযোগ্য। এসব জাহাজে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে সময় লাগে মাত্র দুই ঘণ্টা। অন্যদিকে প্রতিদিনই বিকাল ৩টায় এসব সাহাজ সেন্টমার্টিন ছেড়ে আসে। শীত মৌসুমে সমুদ্র শান্ত থাকে এবং গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে সমুদ্র উত্তাল থাকে, তখন চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
কোথায় খাবেন : যারা স্বল্প সময়ের জন্য সেন্টমার্টিনে ঘুড়তে যেতে চান অর্থাৎ সন্ধ্যার আগে ফিরতে চান তাদের অবশ্যই ৩টার আগের জাহাজে উঠতে হবে। ছোট এই দ্বীপ এলাকা ঘুরে দেখতে মাত্র ৩ ঘণ্টা সময়ই যথেষ্ট। তবে প্রধান দ্বীপ ও ছেড়া দ্বীপে যেতে চান তাহলে হাতে বেশ খানিকটা সময় রাখতে হবে। পর্যটকদের খাবারের জন্য রয়েছে এখানে অনেকগুলো হোটেল ও রেস্তোরাঁ। তার কয়েকটির নাম হল কেয়ারি মারজান রেস্তোরাঁ, বিচ পয়েন্ট, । হোটেল আল্লার দান, বাজার বিচ। এছাড়া আসাম হোটেল, সি বিচ, সেন্টমার্টিন, কুমিল্লা রেস্টুরেন্ট, রিয়েল রেস্তোরাঁ, হাজী সেলিম পার্ক, সেন্টমার্টিন টুরিস্ট পার্ক, হোটেল সাদেক ইত্যাদি।
থাকবেন কোথায় : সেন্টমার্টিনে থাকার জন্য উন্নতমানের কয়েকটি হোটেল ও কটেজ রয়েছে। ১৬টি হোটেলসহ বেশ কয়কটি কটেজে রয়েছে প্রতিরাতে কমপক্ষে পাচশ জন পর্যটক থাকতে পারেন সেখানে। অনেক বাড়িতেও রয়ছে পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা। ভাড়া ২০০-২৫০ টাকা, শীত মৌসুমে চাপ বেশি বিধায় ইচ্ছামতো ভাড়া নেয় মালিকরা।![Coxs-Bazar-Pic-08.jpg](https://steemitimages.com/DQmQU2eXAqRxdPsCdvjADBRjDHfUTrrkbPj5aoSxmNz1RNN/Coxs-Bazar-Pic-08.jpg)